২০২৩-০৭-২২ ১১:১৯:০৪ / Print
বিশ্বজুড়ে যেভাবে তাপমাত্রা ও সামুদ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের বরফের স্তর গলে যাওয়ার ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে তাতে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, যে রকম দ্রুত গতিতে এবং যে সময়ের মধ্যে এসব রেকর্ড ভাঙা-গড়া চলছে তা 'নজিরবিহীন'।
জাতিসংঘ বলছে, ইউরোপজুড়ে যে তাপপ্রবাহ চলছে তা আরও রেকর্ড ভাঙতে পারে। খবর বিবিসির
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব নজিরবিহীন রেকর্ড জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা কঠিন, কারণ আবহাওয়া ও মহাসাগরের আচরণ খুবই জটিল। এসব নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা‒ খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের পরিবেশগত ভূগোলবিদ টমাস স্মিথ বলেন, 'আমার এমন কোনো সময়ের কথা জানা নেই যখন জলবায়ু ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ধরনের রেকর্ড ভাঙা ও অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে।'
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জলবায়ু বিজ্ঞানের লেকচারার ড. পল সেপ্পির মতে, 'পৃথিবী এখন লাগামহীন পরিবর্তনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে' যার পেছনে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ঘটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং ২০১৮ সাল থেকে প্রথম 'এল নিনো'র প্রভাবে পৃথিবীর গরম হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়গুলো।
এল নিনো প্রকৃতি গরম হয়ে ওঠার একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা হয় যখন প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণমণ্ডলীয় অংশে সমুদ্রের তপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যায়, যার প্রভাবে প্রকৃতি গরম হয়ে ওঠে।
এ বছর গ্রীষ্মে চারটি রেকর্ড ভাঙা অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গেছে। এ বছরের জুলাই মাসে ছিল এ যাবৎ পৃথিবীতে উষ্ণতম দিনের রেকর্ড। ২০১৬ সালে বিশ্বে গড় উষ্ণ তাপমাত্রার যে রেকর্ড ছিল এবারের তাপমাত্রা তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
এবার প্রথমবারের মত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ইইউর জলবায়ু পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপার্নিকাস জানাচ্ছে, ৬ জুলাই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭.০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তেল, কয়লা ও গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে যে কার্বন নিগর্মণ হচ্ছে পৃথিবীর ক্রমশ গরম হয়ে ওঠার পেছনে সেটাই বড় কারণ।
ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের আরেক জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. ফ্রেডেরিকো অটো বলছেন, গিনহাউস গ্যাস থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া ঠেকানো না গেলে এমনটাই ঘটবে বলে পূর্বাভাস করা হয়েছিল। এর জন্য মানুষই দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
ড. ফ্রেডেরিকো অটো বলেন, 'আমি যে কারণে বিস্মিত সেটা হলো‒ জুনে যেভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড ভাঙছে। বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে এত তাড়াতাড়ি এমনটা ঘটার কথা নয়।'
তিনি বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে, কিন্তু সেটার প্রভাব এত তাড়াতাড়ি দেখা যাওয়াটা অস্বাভাবিক।
বিশ্বব্যাপী মহাসাগরের তাপমাত্রা মে, জুন ও জুলাইয়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৬ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রার যে রেকর্ড হয়েছিল, বর্তমান তাপমাত্রা দ্রুত তাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তাপমাত্রা যে অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ছে তাতে বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে শঙ্কিত।
ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির আর্থ সায়েন্সের অধ্যাপক ড্যানিয়েলা শ্মিড বলেন, 'আটলান্টিকের এই অংশে এ ধরনের সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ আগে কখনও দেখা যায়নি। এটা আমাদের ধারণার বাইরে।'
আয়াল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের তাপমাত্রা জুনে স্বাভাবিকের তুলনায় চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল, যা ন্যাশানাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সংজ্ঞায় ক্যাটাগরি ৫ তাপপ্রবাহ অর্থাৎ 'চরম অবস্থারও বেশি'।
এর কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন কিনা তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তবে তিনি বলছেন পৃথিবী গরম হয়ে উঠেছে এটা পরিষ্কার এবং মহাসাগরগুলো আবহাওয়া মণ্ডল থেকে অতিরিক্ত উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রের এই জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর ৫০ শতাংশ অক্সিজেন জোগায়।
"আমরা যখন তাপপ্রবাহের কথা বলি মানুষ ভাবে তাতে শুধু গাছপালা, ঘাসপাতা মরে যায়। কিন্তু মহাসাগরের পানি যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি বেড়ি যায়, তখন সামুদ্রিক জীব ও গাছপালার বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি ৫০ শতাংশ খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
দক্ষিণ মেরু সাগরে বরফের স্তর জুলাই মাসে ছিল রেকর্ড পরিমাণ কম। ব্রিটেনের আয়তনের দশগুণ পরিমাণ আয়তনের বরফের স্তর গলে গেছে। ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে যে পরিমাণ বরফের আস্তরণ ছিল এই গলে যাওয়া বরফের পরিমাণ তার তুলনায় রেকর্ড মাত্রায় কমে গেছে। এই পরিবর্তনের কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা রীতিমত চিন্তিত।
পৃথিবীর আবহাওয়া যেমন আশঙ্কাজনকভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে, তাতে দক্ষিণ মেরু সাগরের বরফের স্তর উদ্বেগজনক হারে গলে যাচ্ছে। তবে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের ড. ক্যারোলাইন হোমস বলছেন, স্থানীয় আবহাওয়ার কারণে অথবা মহাসমুদ্রের কারেন্টের ফলেও এটি ঘটতে পারে।
তিনি বলছেন, শুধু রেকর্ড ভাঙার কারণেই যে তারা উদ্বিগ্ন তা নয়, যে মাত্রায় রেকর্ড ভাঙছে সেটাও তাদের ভাবাচ্ছে।
ড. ক্যারোলাইন হোমস বলেন, 'জুলাই মাসে এই পরিমাণ বরফ গলা আমরা আগে কখনও দেখিনি। এর আগে বরফ গলে যে মাত্রায় নেমে এসেছিল এই মাত্রা তার আরও ১০ শতাংশ নিচে। এটা বিশাল। যে দ্রুত হারে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তার কারণ যে আমাদের কাছে এখনও কতটা ধাঁধাঁর মত এটা তার আর একটা উদাহরণ।'
আসলে যে দ্রুত পরিবর্তনগুলো ঘটছে আর যে দ্রুত গতিতে আগের রেকর্ডগুলো ভাঙছে সেটাই বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করছে। তারা আগামীতে আবহাওয়া মণ্ডলে আরও রেকর্ড ভাঙা অঘটনের আশঙ্কা করছেন। ২০২৪ সালেও নানা দুর্যোগ ঘটবে বলে তারা মনে করছেন।
তবে ড. ফ্রেডেরিকো অটো বলছেন, এর মানে এই নয় যে 'জলবায়ু ধ্বংস' হয়ে গেছে। তার মতে, নতুন পরিস্থিতির আলোকে 'পৃথিবীকে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী করে তোলার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি'।