শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ইংরেজী, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বাংলা ENG

ধানের রেকর্ড উৎপাদনের পরও খাদ্য অধিদপ্তরে চাল দিচ্ছেন না মিল মালিকরা

স্টাফ রিপোর্ট ::

২০২৩-০১-০৪ ২১:০৮:৫২ /

পর্যাপ্ত ধান-চাল সংগ্রহে সরকার এবার দাম বাড়ালেও সেটি কোনো কাজে আসছে না। ধানের রেকর্ড উৎপাদনের পরেও খাদ্য অধিদপ্তরে চাল দিচ্ছেন না মিল মালিকরা। বিভিন্ন কৌশল ও নানা অজুহাতে শেষ পর্যন্ত চাল দিতে চুক্তির আওতায় আসেননি অনেকে।

পর্যাপ্ত ধান-চাল সংগ্রহে সরকার এবার সামান্য দাম বাড়ালেও সেটি কোনো কাজে আসছে না। কম দাম, ধান দেয়ায় অ্যাপস ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে কৃষকদের অনীহা।

সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের হোঁচট খেতে হচ্ছে।

চলতি মওসুমে খাদ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগে ২০ হাজার টন ধান ও ১৩ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।

বুধবার (৪ জানুয়ারী) পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩৬০ টন ও চাল সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে ৮ হাজার টন। দেড় মাসেরও বেশী সময়ে এই সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

যদিও খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বলছেন নির্দিষ্ট সময়ের আগে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এবং ধান সংগ্রহও লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মওসুমে খাদ্য অধিদপ্তর সিলেট জেলায় ৪ হাজার টন ধান ও সাড়ে ৩ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। বিপরীতে বুধবার (৪ জানুয়ারী) পর্যন্ত জেলায় ৩০০ টন ধান সংগ্রহ ও ১ হাজার ৭০০ টন চাল সংগ্রহের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলায় ৩ হাজার ৮৪৩ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বুধবার পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৪৫ টন। ২ হাজার ৭২৪ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চুক্তি হয়েছে ২ হাজার ৪৮৩ টন। সংগ্রহ হয়েছে ২৪৫ টন।

মৌলভীবাজার জেলায় ৫ হাজার ৫৩৯ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বুধবার পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২০ টন। ৩ হাজার ২৩৫ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ মাত্র ২৪০ টন।

হবিগঞ্জ জেলায় ৪ হাজার ৪৯৬ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৬ টন। ৩ হাজার ৪৬৪ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চুক্তি হয়েছে ২ হাজার ৭৪ টন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক এবারের আমন মৌসুমের (২০২২-২৩) ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা ১৭ নভেম্বর থেকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

এ প্রেক্ষাপটে ৫ লাখ টন চাল ও ৩ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৫০০ টন। দেশের হাট-বাজারে ধান কেনার উপযুক্ত সময় প্রায় শেষের দিকে। অথচ সরকারের গুদামে ধান দেননি কৃষক।

৫ লাখ টনের বিপরীতে এ পর্যন্ত চাল সংগ্রহ হয়েছে দেড় লাখ টন। আর মিল মালিকদের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত ৭ হাজার ৯১ জন সিদ্ধ চাল কল মালিকের সঙ্গে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৮৭২ টন চালের চুক্তি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

অর্থাৎ ধান-চাল মিলে যেখানে ৮ লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সেখানে সরকারের গুদামে এসেছে মাত্র দেড় লাখ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮ শতাংশ। ফলে লক্ষ্যমাত্রার ৭২ শতাংশই ঘাটতি রয়ে গেছে।

মিল মালিকরা বলছেন, এবার প্রতি কেজি চাল কেনা হচ্ছে ৪২ টাকা আর ধান ২৮ টাকায়, যা বাজারদরের চেয়ে অনেক কম। সে কারণেই অনীহা তাদের। একই কারণে ধান দেননি চাষিরাও। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকায় কৃষকরা স্থানীয় বাজারেই ধান বিক্রি করছেন।

গত আমন মৌসুমে (২০২১-২২) এর চেয়েও কম দামে ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছিল। সে সময় ২৭ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৪০ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার।

এবার মিলারদের অনাগ্রহের কারণে সে দর বাড়িয়ে নির্ধারণ করেও কাজ হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাল দেওয়ার জন্য এবার চুক্তি করছেন না মিলাররা। খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, সরকারকে চাল দিতে পারে এমন চুক্তিযোগ্য চালকল মালিকের সংখ্যা ১২ হাজার ৬৮০ জন। এ মৌসুমে আমন সংগ্রহের জন্য ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত চুক্তির মেয়াদে চুক্তিভুক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৯১ জন।

তবে ৫ হাজার ৫৮৯ মিল মালিক বারবার সময় দিয়েও চুক্তি করেননি।

এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ শাখার পরিচালক রায়হানুল কবীর জানান, চুক্তিযোগ্য যেসব মিল আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

১৮ ডিসেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরের মাসিক সমন্বয় সভায় চলতি আমন মৌসুমে যে সব মিলার বরাদ্দ অনুযায়ী চুক্তি করেননি তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তিনি জানান, মৌসুমে চুক্তিযোগ্য যেসব মিলার বরাদ্দ অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদন করেননি, এমন মিলারদের কারণ দর্শানোর জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

কী ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট জানাননি রায়হানুল কবীর। তবে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের তালিকা অনুযায়ী কারসাজির সঙ্গে জড়িত চালকলগুলোর জামানত বাজেয়াপ্তসহ কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানিয়েছে, এবার আমন মৌসুমে ধানের আবাদ হয়েছে ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল এক কোটি ৫৯ লাখ ৮৬ হাজার টন।

সুনির্দিষ্ট উৎপাদনের তথ্য এখনো না এলেও সারাদেশে এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রাথমিক তথ্য বলছে, এবছর আমনের উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৬৩ লাখ টন চাল।

এত উৎপাদনের পরেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতাকে চালকল মালিকদের কারসাজি বলেও মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তারা বলছেন, দাম বাড়ানোর চাপে রাখতে সরকারের গুদামে চাল দিচ্ছেন না মিল মালিকরা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, মিল মালিকরা বরাবরই সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেন, কিন্তু পরে চাল দেন না। তবে কখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সেজন্য তারা বেপরোয়া। তাদের কারণে বারবার বাজারে চাল সরবরাহে ভাটা পড়েছে। এতে চালের দাম আরও বাড়ছে। নিজেদের হাতে চালের মজুত রেখে দাম বাড়ানো তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।

সরকারী গুদামে ধান না দেয়ার ব্যপারে কৃষকরা জানান, সরকারের গুদামে ধানের দাম মাত্র ২৮ টাকা কেজি। অর্থাৎ মন হাজার টাকার কিছু বেশি পড়ে। কিন্তু এবার জ্বালানি তেলের দামের কারণে জমিতে সেচের খরচ বেশি।

অন্যদিকে সার, বীজ, কীটনাশকের দামও বেড়েছে। তাতে এ দামে পোষায় না। তারা বলছেন, সরকারি গুদামে চাল দিতে অনেক ঝামেলা হয়।

পরিবহন খরচ বেশি। এছাড়া অ্যাপসের মাধ্যমে ধান বেচতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। অ্যাপস আমরা বুঝি না। অন্যদিকে ধান বিক্রির পর কৃষকের ব্যাংক হিসাবে দেয়া হয় টাকা। এত ঝামেলা করার কী দরকার!

সরকারকে চাল না দেয়ার ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানান, খাদ্য বিভাগ ৪২ টাকা কেজি দরে চাল কিনবে। তবে বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি চাল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ অবস্থায় লোকসান দিয়ে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সে কারণে কেউ চাল দিতে চায় না। তবে জামানত বাজেয়াপ্ত ও ঝামেলা এড়াতে তালিকাভুক্তরা অনেকে বাধ্য হয়ে চাল দেন।

সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নয়ন জ্যোতি চাকমা বলেন, চলতি আমন মওসুমে সিলেট জেলায় ৪ হাজার টন ধান ও সাড়ে ৩ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা চালের সংগ্রহ অর্ধেক চুক্তি সম্পন্ন করতে পারলেও ধান সংগ্রহ হয়েছে ৩০০ টনের মতো।

সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মইনুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা প্রায় কাছাকাছি। তবে ধান সংগ্রহে আমরা সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কৃষকের আগ্রহ কম থাকায় ধান সংগ্রহ কমেছে।

মৌলভীবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জ্যোতি বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, বাজারে ধানের দাম বেশী থাকায় কৃষক সরকারী গুদামে ধান দিতে চায়না। তাই ধানের সংগ্রহ কম। তবে চাল সংগ্রহে আমরা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে আশাবাদী।

হবিগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক চাই থোয়াই প্রু মার্মা দৈনিক বলেন, আমন সংগ্রহে ধানে কৃষকের আগ্রহ কম থাকায় আমরা চাল সংগ্রহে জোর দিয়েছি। সরকারী নীতিমালার আলোকে ধান সংগ্রহে আমরা কৃষকের অপেক্ষায় আছি।

এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, চলতি মওসুমে বাজারে ধান ও চালের ভালো দাম। তাই কৃষকের ধান দিতে আগ্রহ কম।

ধান সংগ্রহ কম হলেও আমরা চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবো। এছাড়া বর্তমানে সিলেট বিভাগে সরকারী গুদামে ৬০ হাজার টন চাল মজুদ আছে।

এ জাতীয় আরো খবর

বাজার নিয়ন্ত্রণে ৮৩ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির উদ্যোগ

বাজার নিয়ন্ত্রণে ৮৩ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির উদ্যোগ

উৎপাদন খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা:  আমদানির খবরে ঠাকুরগাঁওয়ে কমছে আলুর দাম

উৎপাদন খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা: আমদানির খবরে ঠাকুরগাঁওয়ে কমছে আলুর দাম

 আরো ১ লাখ ১৬ হাজার ২৪৯ জন বিদ্যুৎ গ্রাহক প্রি-পেমেন্ট মিটারের আওতায় আসছেন

আরো ১ লাখ ১৬ হাজার ২৪৯ জন বিদ্যুৎ গ্রাহক প্রি-পেমেন্ট মিটারের আওতায় আসছেন

গ্যাস সরবরাহে শিল্প, সার ও বিদ্যুত খাতকে  অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে: সিলেটে  পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান

গ্যাস সরবরাহে শিল্প, সার ও বিদ্যুত খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে: সিলেটে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান

সিলেটের জাহেদ ইকবাল দেশের সর্বোচ্চ করদাতা

সিলেটের জাহেদ ইকবাল দেশের সর্বোচ্চ করদাতা

 তেলের খনি : পদ্ধতিগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া অবলম্বনের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

তেলের খনি : পদ্ধতিগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া অবলম্বনের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের