রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এখন আর আশঙ্কা নয়। দেশ দুটির মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। খবর আসছে হতাহতের ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির। পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নানাভাবে যুদ্ধকে প্রভাবিত করার চেষ্টায় আছে বিভিন্ন শক্তি। কিন্তু কিয়েভের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কী করছে এতদিন ধরে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসা পশ্চিমারা?
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনে অভিযানের নামে চলমান রুশ আগ্রাসনের সামনে অন্য কোনো রাষ্ট্র কেন সমরাস্ত্র নিয়ে দাঁড়াচ্ছে না? আর সম্মিলিত পাল্টা হামলা হলে এ সংঘাতের জল কতদূর গড়াতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাব প্রায় স্পষ্ট। পুরো পৃথিবীতে ছায়া ফেলতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ। ঘনিয়ে আসতে পারে পরমাণু যুদ্ধের মতো মহাবিপর্যয়।
ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনে রাশিয়ার সব পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে অনেক দেশ। বেলারুশসহ কয়েকটি শক্তি প্রত্যক্ষ সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু কিয়েভের পক্ষে এখনও পর্যন্ত কেউ সমরশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। নানা বিষয়ে ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউক্রেনের প্রধান মিত্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র।
ন্যাটোর মতো সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ও শক্তি হাতে থাকার পরও ব্যবহার করছে না পশ্চিমারা। এ প্রেক্ষাপটে আরও যেসব বাস্তবতা অন্য পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোকেও ভাবাচ্ছে তা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিশ্চিয়ান রোমান্সের বিশ্লেষণ।
তিনি বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গেলে পশ্চিমারা নিজের পায়ে কুড়াল মারবে। এর চড়া মূল্য চুকাতে হবে, ভুগতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। এক কথায় মস্কোকে শাস্তি দিলে সেই শাস্তি পশ্চিমাদেরই ঘাড়ে এসে পড়বে। কেননা, সৌদি আরবের পরে রাশিয়া সবচেয়ে বড় জ্বালানি উৎপাদনকারী।
দেশটির তেল ও গ্যাসে প্রায় আসক্ত আমদানিকারক দেশগুলো। আর শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নই তাদের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশের বেশি প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প স্থগিত করেছে জার্মানি। আসলে এটি এক ধরনের নাটক। কারণ, সম্প্রতি রাশিয়ার সাবেক এক প্রেসিডেন্ট টুইটার পোস্টে বলেছেন, এমন বিশ্বে আপনাদের স্বাগত। শিগগির ইউরোপকে প্রতি এক হাজার ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে হবে দুই হাজার ইউরোতে।
ইউক্রেনের দুটি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপদ ও সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে ভাবা হলো নিষেধাজ্ঞা আরোপকে। এ জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হলো রাশিয়ার ধনকুবের ও ব্যাংকসহ বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাদের বিশ্বাস, এতে রুশ অর্থনীতিতে ধস নামবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে রপ্তানি বাণিজ্য। পরিশেষে এর জন্যও চরম মাশুল দিতে হবে পশ্চিমাদেরই। কারণ, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে, পৌঁছে গেছে গত আট বছরের শীর্ষে। আর রুশ জ্বালানির সবচেয়ে বড় গ্রাহক পশ্চিমারা। এসব দেশের নাগরিকরা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জন্য তাদের নেতাদের মসনদ কাঁপিয়ে দিতে পারেন। প্রভাব পড়তে পারে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর আসন্নম্ন জাতীয় নির্বাচনে। এ বিষয়গুলো পরোক্ষভাবে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নেতাদের হাত বেঁধে ফেলেছে বলে মনে করেন সিএনএনের রাজনীতি বিশ্নেষক জশ রোগিন-ও। তারপরও রাশিয়ার ওপর প্রথম দফার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এই পদক্ষেপের ভার তাদের নাগরিকদেরও বইতে হবে বলে স্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
জশ রোগিন বলেন, জ্বালানির বাজার প্রভাবিত করতে রাশিয়ার কাছে অনেক বিকল্প উপায় আছে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমাদের সক্ষমতা সীমিত। পশ্চিমা নেতাদের এসব দুর্বলতার পাঠ পুতিন ভালো করেই অধ্যয়ন করেছেন। তা ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্মিলিত হামলার সুযোগ নেই। এমন সিদ্ধান্তের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য দেশের অনুমোদন লাগবে। যেখানে মস্কোর নিজেরই ভেটোর ক্ষমতা আছে। পাশে আছে অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। তাদেরও ভেটোর ক্ষমতা আছে। গণতান্ত্রিক পদক্ষেপের এই পদ্ধতিও পুতিনের পক্ষে। সার্বিক বিবেচনায় মহাবিপর্যয় এড়াতে রাশিয়াকে আঘাত করা সম্ভব নয়।