‘দখলদার পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সোনার বাংলা মুক্ত’- ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই শিরোনামে প্রধান সংবাদ প্রকাশ করে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের অন্যতম মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাক। স্টাফ রিপোর্টার ক্রেডিট লাইনে লিখা সংবাদটি ছিল এরকম- ‘সাবাস মুক্তিযোদ্ধা! বিগত ২৫শে মার্চের বিভীষিকাময় রাত্রির অবসান ঘটিয়াছে। দখলদার পাক-বাহিনী গতকাল (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ সময় অপরাহ্ন ৫.১ মিনিটের সময় বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছে; জন্ম লইয়াছে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ও অষ্টম বৃহত্তম স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা দেশ।’ ‘এই আত্মসমর্পণের ভিতর দিয়াই সোনার বাংলা এবং তার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন হইতে বিভীষিকাময় তিমিরের অবসান ঘটিয়াছে। রক্তস্নাত বাংলা দেশের পূর্ব দিগন্তে আজ স্বাধীনতার অম্লান সূর্য উদ্ভাসিত। আজিকার এই শুভলগ্নে আমরা স্মরণ করিতেছি সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যাঁরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবী আদায়ের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়াছেন, সান্ত্বনা দিতেছি সন্তানহারা মাকে, স্বামীহারা স্ত্রীকে, পিতৃ-মাতৃহারা এতিম সন্তানদের। এই সংগে স্মরণ করিতেছি স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি আজকের এই মূহূর্তে পর্যন্তও পাক সেনাবাহিনীর কারাগারে অন্ধ-প্রকোষ্ঠে আটক। সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ তাই তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।’ এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের খবর প্রচার করেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অপরিহার্য দলিল দৈনিক ইত্তেফাক।
কিংবদন্তী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রতিষ্ঠিত ইত্তেফাক পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ দেশে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের জুলুম-নির্যাতন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনতাকে সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত করতে সাহসী ভূমিকা রাখে। জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও ইত্তেফাকের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। এজন্য ইত্তেফাকের উপর বার বার আঘাত এসেছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারাগারে যেতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে পাক-হানাদাররা ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে ইত্তেফাক। স্বাধীনতাত্তোর গত ৫ দশকে ইত্তেফাক এর গল্প শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। ঐতিহ্যকে ধারণ করে সগৌরবে পথ চলার।
২৪ ডিসেম্বর ৬৮ বছরে পা দিয়েছে ইত্তেফাক। শুভ জন্মদিন ইত্তেফাক। নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা কিশোর-তরুণ তাদের অনেকের কাছেই ইত্তেফাক ছিল রূপালী জগতের স্বপ্নের নায়ক-নায়িকাদের কাছে থেকে দেখার অন্যতম মাধ্যম। আজও মনে পড়ে ইত্তেফাকে প্রকাশিত সিনেমার বিজ্ঞাপনের কথা। প্রিয় নায়ক-নায়িকার নতুন কোন সিনেমা কবে মুক্তি পাবে, কোন কোন হলে চলবে, তা নোট করে রাখতাম। সময়-সুযোগ হলে বন্ধুরা মিলে কুলাউড়া থেকে ট্রেনে চড়ে সিলেটে এসে এসব সিনেমা দেখতাম।
ইত্তেফাকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত টারজান সিরিজের কমিক না পড়া পর্যন্ত মন উসখুস করতো। কঁচিকাঁচার আসর মন রাঙিয়ে দিত। সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি লিখা শিখতে গিয়ে ইত্তেফাকের ১ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ঠিকানা আমরা পাঠ্যপুস্তক থেকে মুখস্ত করেছি। এভাবেই ইত্তেফাকের সঙ্গে বেড়ে ওঠা।
কর্মজীবনে সেই ইত্তেফাক ছিল আমার এক দশকের ঠিকানা। ২০০৭ সালে আমি তখন দৈনিক সমকালে নিজস্ব প্রতিবেদক ও সিলেট ব্যুরো চিফ। বছরের শেষ দিকে ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলাম সিলেট ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ করার। আজও স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন প্রস্তাবটি এসেছিল, সেই রাতে রোমাঞ্চ-উত্তেজনায় ঘুমাতে পারিনি। স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। তবে সমকাল ছেড়ে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারছিলাম না। চরম অস্থিরতা আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই। সিদ্ধান্ত নিলাম বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকতুল্য কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার। এরপর ইত্তেফাকের প্রস্তাবের কথা জানাই, সিলেটে আমার শ্রদ্ধেয় অভিভাবক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ লোকমান আহমদকে। খবরটি শুনে তিনি খুব খুশি। তবে সমকাল ছেড়ে যেতে হবে এই ভাবনায় তিনিও কিছুটা চিন্তিত। বললেন, ইত্তেফাকের ঐতিহ্যের অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। কথা বলি সমকালের তখনকার সম্পাদক, দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, শ্রদ্ধেয় আবেদ খানের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাকের প্রস্তাবের কথা শুনে আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। তবে সমকাল ছেড়ে যাব কি-না তা আমার ওপরই ছেড়ে দিলেন।
তবে একথাও বললেন, ইত্তেফাকের ঐতিহ্যের সঙ্গে কোন কিছুরই তুলনা হয় না। অবশেষে ইত্তেফাকের ঐতিহ্যবাহী ও অভিজাত পরিবারে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সময়ের প্রয়োজনে আজ আমি নতুন ঠিকানায়। তবে ইত্তেফাকে কাজ করার শত-সহস্র মধুর স্মৃতি সবসময়ই মনে গেঁথে আছে। ইত্তেফাকের জন্মদিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ইত্তেফাকের সাবেক বার্তা সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় রাশীদ উন নবী বাবুসহ আমার যেসব সহকর্মী চিরঘুমের দেশে চলে গেছেন।
শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি ইত্তেফাকের সিলেটের সুদীর্ঘকালের ব্যুরো চিফ, শ্রদ্ধেয় আবদুল মালিক চৌধুরীকে এবং বর্তমান ব্যুরো চিফ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে। জয়তু ইত্তেফাক।
লেখক: ইত্তেফাক’র সাবেক সিলেট ব্যুরো চিফ, বর্তমানে দৈনিক দেশ রূপান্তর’র নিজস্ব প্রতিবেদক ও দৈনিক উত্তরপূর্ব’র বার্তা সম্পাদক।
Editor Incharge: Faisal Ahmed Bablu
Office : 9-C, 8th Floor, Bluewater Shopping City, Zindabazar, Sylhet-3100
Phone: 01711487556, 01611487556
E-Mail: sylhetsuninfo@gmail.com, newssylhetsun@gmail.com
Publisher: Md. Najmul Hassan Hamid
UK office : 736-740 Romford Road Manor park London E12 6BT
Email : uksylhetsun@gmail.com
Website : www.sylhetsun.net