কবি নজরুল ও নারী : প্রসঙ্গ ফজিলাতুন্নেছা

অধ্যাপক মু. নজরুল ইসলাম তামিজী || ২০২২-০৭-১৭ ১১:২১:১৫

image

জীবনের নানা স্তরে কবি নজরুলের সঙ্গে বিভিন্ন নারীর বিচিত্রসব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তার মধ্যে কেউ হয়েছেন জননী স্বরূপা, কেউবা প্রেয়সী অথবা ভগিনী। এর মধ্যে যখন যে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন কবি, তখনই তার আরাধনার চূড়ান্ত করেছেন।

মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে কবিকে যেমন আকুল হতে দেখা যায়, প্রেয়সীকে কাছে পাবার জন্যেও তেমনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কবি। তবে তার মাতৃভক্তি সকল ক্ষেত্রে অক্ষুন্ন থাকলেও নিজের জন্মদাত্রী জননী এই পুত্রভক্তির অঞ্জলি থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

একইভাবে প্রিয়তমা প্রেয়সীর জন্য হৃদয় তার হাহাকার করে উঠলেও এ সম্পর্কে বিরূপ অনুভূতিও কখনো কখনো তার কবি মনকে তাড়িত করেছে। নারী সম্পর্কে কবির মনোভাবের এই পার্থক্যের কারণ নিঃসন্দেহে তার রক্তে-মাংসে গড়া দেহ-মন এবং দয়িতার ছলচাতুরীও বটে।নারীকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কবি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। তারমধ্যে ‘নারী’ নামেই তার একাধিক কবিতা রয়েছে।

এর একটি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে, অপরটি ‘শেষ সওগাত’ এ সঙ্কলিত হয়েছে। এছাড়াও অজস্র প্রেমের কবিতা-গানে নারী সম্পর্কে কবি তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। যার অধিকাংশই অনুকূল মনোভাবের প্রকাশে অলংকৃত, কিছু কিছু অবশ্য ব্যতিক্রম, বীতশ্রদ্ধ উপলব্ধির প্রকাশও রয়েছে। ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী।

তাঁর বাবা আবদুল ওয়াহেদ খান টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার বাড়িতে চাকরি করতেন। তবে ধারণা করা যায়, মেয়েকে ঢাকায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো আর্থিক সংগতি তাঁর ছিল না। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসার জীবনের লক্ষ্য যেমন ছিল সুদূর; সেই লক্ষ্য পূরণে তাঁর সাহস ও একাগ্রতাও ছিল বিস্ময়কর।

সেই আমলে রক্ষণশীল সমাজে একজন মুসলিম মেয়ের পক্ষে ঢাকায় একা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কতটা দুরূহ ছিল, আজকের দিনে তা কল্পনা করাও কঠিন। যদিও মাঝে মাঝে তাঁর বোন শফিকুন্নেসা তাঁর সঙ্গে থাকতেন। ফজিলাতুন্নেসা বৃত্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু যে পড়াশোনা করেছেন তা নয়, গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে তাঁর মেধারও প্রমাণ রেখেছেন।

১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ঢাকা এসেছিলেন নজরুল। এই সংগঠনের সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ সময়ে ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। নজরুল হস্তরেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন শুনে নিজের ‘ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ’ জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসা।

সোৎসাহে বন্ধু মোতাহারকে নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন নজরুল। পরিচয় ও হস্তরেখা বিশ্লেষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরের ঘটনাটি রহস্যময়। সেই রহস্যের কিনারা এখনো হয়নি। তবে কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণায় এটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এরপর কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেসার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে একা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন নজরুল।

এই বিদূষী নারীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কিন্তু এতকাল যে তরুণীদের সঙ্গে সান্নিধ্যের সুযোগ তাঁর হয়েছিল, ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অন্য ধাতুতে গড়া এই নারী তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁকে। প্রত্যাখ্যানের ভাষা ও আচরণ ছিল রীতিমতো কঠোর। এই আঘাত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল কবিকে।

এই একটি সম্পর্ক রূঢ় প্রত্যাখ্যানের রূপটি চিনিয়েছিল কবিকে। সমুদ্রের ঢেউভাঙা জলের মতো নজরুলের নিবেদন স্পর্শ করতে চেয়েছে ফজিলাতুন্নেসার চরণ, কিন্তু কী আশ্চর্য উপেক্ষার শক্তি ছিল শ্যামাঙ্গী তরুণীর! তিনি ফিরে তাকালেন না, বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-অবহেলায় ক্ষত-বিক্ষত করেছেন কবির হৃদয়। কবি নজরুলের মোট আটটি চিঠি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

তার মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা সাতটি এবং ফজিলাতুন্নেসাকে লেখা একটি। ফজিলাতুন্নেছাকে লেখা চিঠিতে যে ব্যথিত-অপমানিত, কাতর ও গ্লানি-জর্জরিত নজরুলকে পাওয়া যায়, তা তুলনারহিত।

বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিগুলো ফজিলাতুন্নেসাও পড়ুক এটাই কবি চাইতেন। তাঁর চিঠিতে সেই আগ্রহের কথা উল্লেখ আছে। কলকাতা ফিরে গিয়ে সম্ভবত অনুতাপ প্রকাশ করে এবং তাঁকে ভুল না বোঝার আকুতি জানিয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে চিঠি লিখেছিলেন কবি।

এতে কবির প্রতি সমস্ত অভিযোগ ভুলেছিলেন ফজিলাতুন্নেসা—এমন তো নয়ই, উল্টো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছিলেন তাঁকে। সেই চিঠিতে তিনি কী লিখেছিলেন, তা হুবহু জানার উপায় নেই; কারণ সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মোতাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, সেই চিঠির ভাষা তাঁর জীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল, ‘আঘাত আর অপমান এ দুটোর প্রভেদ বুঝবার মতো মস্তিষ্ক আমার আছে।

আঘাত করবার একটা সীমা আছে, যেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে, আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা।’ এ রকম অপমানিত হয়েও কি ফজিলাতুন্নেসাকে ভুলতে পেরেছিলেন কবি? পারেননি। নিজের ভুলকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে—‘কয় মুহূর্তের দেখা, তারি মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়ত বা কত অপরাধও করে ফেলেছি।

পাওয়ার বেভুল আনন্দে কী করেছি না করেছি, কী লিখেছি না লিখেছি তা আমার মনে নেই কোনদিন মনে পড়বেও না।’...তাঁর আঘাত বেদনা অশ্রু আমার শ্বাশতলোকের শূন্য ভান্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান নলিনীমোহন বোসের প্রিয় ছাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন্নেসা।

তিনি অধ্যবসায়ী এই ছাত্রীকে নানাভাবে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন, যাতে বয়সসুলভ চঞ্চলতা তাঁকে ‘বিপথে’ নিতে না পারে। ফজিলাতুন্নেসাও ড. বোসকে ‘দেবতার’ আসনে বসিয়েছিলেন। আলাপ-পরিচয়ের প্রথম পর্বেই এই শিক্ষকের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার কথা হয়তো নজরুলকে জানিয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। এ ব্যাপারটি একেবারেই সহ্য করতে পারেননি নজরুল। তাঁর প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও মিলনের ক্ষেত্রে এই লোকটিকেই বড় একটি বাধা বলে মনে হয়েছে তাঁর।

মোতাহারকে লেখা চিঠিতে তাই এই শিক্ষকের প্রতি বিষোদ্গার করতে ছাড়েননি নজরুল, ‘কোন নারী, সুন্দরের উপাসিকা নারী কোন অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারিনে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষী, সে অঙ্কশাস্ত্রীর ভাড়ার রক্ষী হবে কেন?...আমি তাকে বলি প্রাণহীন যক্ষ। অকারণে ভূতের মতো রত্ন মানিক আগলে বসে আছে। সে রত্ন কিন্তু গলায় নিতে পারে না-অন্যকেও নিতে দেবে না।’ ঈর্ষা তাঁর এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এ কথাও লিখেছেন, ‘এখন কেবলি মনে হচ্ছে কী ছাই করলুম কবিতা লিখে।

তার চেয়ে অঙ্কের প্রফেসর হলে ঢের বেশি লাভবান হতে পারতাম।’ প্রত্যাখ্যানের বেদনা থেকে এ রকম শিশুর মতো অযৌক্তিক ও হাস্যকর কথাও লিখে ফেলতে পেরেছিলেন নজরুল, ‘আমি যদি বি. এ-টা পাস করে রাখতাম তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এম এ-তে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলে।’ প্রথমবার ফজিলাতুন্নেসাকে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন, তার রূঢ় উত্তরটা সম্ভবত পরে আর কখনো লিখবার সাহস কেড়ে নিয়েছিল তাঁর।

তবু দীর্ঘদিন বন্ধু মোতাহারের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, এই উছিলায় আরেকটি চিঠি তিনি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে দেখা যায়, যথেষ্ট কুণ্ঠা ও সমীহের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কবি লিখেছেন, ‘আপনি যদি দয়া করিয়া—জানা থাকিলে আজই দু লাইন লিখিয়া তাঁহার খবর জানান, তাহা হইলে সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকিব।’ কিন্তু ‘দয়া করিয়া’ ফজিলাতুন্নেসা এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন, এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।

ফজিলাতুন্নেসাকে ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করতে চেয়ে নজরুল লিখেছিলেন – ‘'আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রাণী, আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতি পত্র লইতে হইবে না।

আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কী সম্মান করিব?’' সেই নারী, ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন নজরুল। অবশ্য সেই সংকলনে রয়েছে একটি গান, যেটি ফজিলাতুন্নেসার বিলেত যাওয়ার আগে, বিদায়-সংবর্ধনার উপলক্ষে লেখা।

আগেই বলেছি মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিগুলো ফজিলাতুন্নেসা পড়ুক, এই ইচ্ছা লালন করতেন নজরুল। এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এ চিঠি শুধু তোমার এবং আরেক জনের। একে সিকরেড (ঐশ্বরিক) মনে করো। আরেকজনকে দিও এ চিঠিটা দুদিনের জন্য।’ ফলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সৈয়দ আলী আশরাফ নজরুলের যে আটটি চিঠি উদ্ধার করেছিলেন ও পরে সংকলিত করেছেন, তার সব কটি চিঠিই ছিল ফজিলাতুন্নেসার জন্য কবির হাহাকার।

ফজিলাতুন্নেসার পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্রয় বা আকর্ষণই ছিল না নজরুলের প্রতি। কারণ ফজিলাতুন্নেসা তখন মেধাবী এক ছাত্রী, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাঁর সামনে। আর নজরুল বিবাহিত, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রয়েছে ভরাট সংসার। নজরুলের প্রেমকে প্রশ্রয় নিয়ে নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করতে চাননি ফজিলাতুন্নেসা।

কিছুকাল এই ‘বিখ্যাত বেদনা’ তাঁকে জর্জরিত করেছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য ফজিলাতুন্নেসা ইংল্যান্ড চলে গেলে ধীরে ধীরে এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন কবি। তবে আঘাতে-অপমানে দীর্ণ দিনগুলো বিফলে যায়নি। আর যাই হোক বাংলা সাহিত্য পেয়েছে কিছু অবিস্মরণীয় গান ও কবিতা।

লেখক : মু. নজরুল ইসলাম তামিজী।

নজরুল গবেষক, মানবাধিকার তাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞানী, শিকড়সন্ধানী লেখক ও চেয়ারম্যান আন্তর্জাতিক নজরুল সাহিত্য পরিষদ

Editor Incharge: Faisal Ahmed Bablu

Office : 9-C, 8th Floor, Bluewater Shopping City, Zindabazar, Sylhet-3100

Phone: 01711487556, 01611487556

E-Mail: sylhetsuninfo@gmail.com, newssylhetsun@gmail.com

Publisher: Md. Najmul Hassan Hamid

UK office : 736-740 Romford Road Manor park London  E12 6BT

Email : uksylhetsun@gmail.com

Website : www.sylhetsun.net