শীতে কীভাবে ভালো থাকবেন শ্বাসকষ্টের রোগীরা?

সিলেট সান ডেস্ক:: || ২০২০-১২-১৮ ০০:০১:৩৯

image

এমনিতে অ্যাজমা আর সিওপিডি রোগীকে সারাবছরই সতর্ক থাকতে হয়।  তবে শীতকালে এই ধরনের রোগীর একটু বেশিই সাবধানে থাকা দরকার।  কারণ শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যায়। হ্রাস পায় আর্দ্রতাও। বায়ুতে বৃদ্ধি পায় ধুলোবালির মাত্রা। এছাড়া ধোঁয়া আর ধূলিকণাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কুয়াশা, ধোঁয়াশা আকছার তৈরি হতে দেখা যায়। মোট কথা, ধুলো, ধোঁয়া, কুয়াশা, ধোঁয়াশা এই সবই অ্যাজমা এবং সিওপিডি রোগীর পক্ষে বিষবৎ। প্রশ্ন হল কেন বিষ? সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আলাদা করে অ্যাজমা এবং সিওপিডি অসুখ সম্পর্কে জানতে হবে।

অ্যাজমা অসুখটি কী?
শ্বাসনালির প্রদাহজনিত অসুখ হল অ্যাজমা। শ্বাসনালীতে প্রদাহ দু’ভাবে হতে পারে। কিছু কিছু বস্তু আছে যেগুলি বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসনালীতে, ফুসফুসে প্রবেশ করলেই প্রদাহ হয়। এই বস্তুগুলির মধ্যে কিছু কিছু উপাদান শ্বাসনালীকে উত্তেজিত করে। আবার কিছু কিছু বস্তুর শ্বাসনালীর সঙ্গে রয়েছে অ্যালার্জির সম্পর্ক!
এই অ্যালার্জি উৎপাদক বস্তুগুলি শ্বাসনালীতে প্রবেশ করা মাত্রই সঙ্গে সঙ্গে প্রদাহ হতে শুরু করে। এই ধরনের অ্যালার্জি সাধারণত অ্যাজমাতে দেখা যায়। প্রদাহ শুরু হলে শ্বাসনালীর পেশিগুলি সংকুচিত হয়ে যায় ও শ্বাসনালী হয়ে পড়ে সরু। শ্বাসনালী বেশি পরিমাণে শ্লেষ্মা উৎপাদন করতে শুরু করে যা শ্বাসনালীর পথ অবরুদ্ধ করে দেয়। ফলে শ্বাস নেওয়া হয়ে পড়ে দুষ্কর।

রোগের উপসর্গ—
শ্বাস নেওয়ার সময় সোঁ সোঁ করে আওয়াজ হওয়া। বাঁশির মতো শব্দ হতে পারে। বুকে চাপ ধরে থাকে। কারও কারও প্রবল কাশি হয়। কিছু কিছু মানুষের রাতে ও ভোরের দিকে কাশির দমক বাড়ে। তার সঙ্গে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট।
কেন হয়?
• কোনও ব্যক্তির ‘অ্যাজমা’র জিন থাকলে এবং ওই জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক পরিবেশে ওই ব্যক্তি বসবাস করলে তার অ্যাজমা রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
• বংশে এই রোগ হওয়ার ইতিহাস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেও এই অসুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
• ধুলো, ধোঁয়া, ডিওড্রেন্ট, পারফিউম, পশুর লোম, আরশোলা, ফুলের রেণু, ঘাস, নানা খাবার থেকে কারও কারও শ্বাসনালীতে অ্যালার্জি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই অ্যালার্জির অন্যতম উপসর্গ হল কাশি ও শ্বাসকষ্ট। অবশ্য কার কোন জিনিসে অ্যালার্জি থাকে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়।
• কারও কারও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। এই ধোঁয়া সরাসরি শ্বাসনালীকে উত্তেজিত করে।
• কিছু ক্ষেত্রে আবার অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ, বেদনানাশক ওষুধ, এমনকী বিটা ব্লকারজাতীয় ওষুধের জন্যও হাঁপানি হতে পারে। এখানেই শেষ নয়। আবার কিছু কিছু ভাইরাসের আক্রমণেও শ্বাসনালীতে অ্যালার্জির মতো প্রতিক্রিয়া হয় ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।

রোগ নির্ণয়
অ্যাজমার সমস্যা খুব ছোট বয়সেও শুরু হতে পারে। তাই বয়স যাই হোক না কেন, উপরিউক্ত যে যে উপসর্গের কথা বলা হল, সেগুলি দেখা গেলেই রোগীকে নিয়ে যেতে হবে একজন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক রোগীকে প্রাথমিকভাবে সাধারণ কয়েকটি পরীক্ষা করাতে দেন। এগুলি হল স্পাইরোমেট্রি, বুকের এক্স-রে এবং ইউসেনোফিল বেশি আছে কি না তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা। এরপর অ্যালার্জি আছে কি না তা বোঝার জন্য আইজিই (ইমিউনোগ্লোবিউলিন ই) পরীক্ষাও করাতে হতে পারে রোগীকে। পরীক্ষাগুলির দ্বারা মূলত চিকিৎসক বোঝার চেষ্টা করেন, রোগীর শ্বাসকষ্টের পিছনে অ্যালার্জি দায়ী নাকি অন্য কোনও কারণ রয়েছে সেই বিষয়টি। অ্যালার্জি দায়ী থাকলে ঠিক কোন বস্তুতে রোগীর অ্যালার্জি আছে তাও বোঝার চেষ্টা করেন চিকিৎসক। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি, আজকাল জানা যাচ্ছে,  অ্যাজমা দু’ধরনের হতে পারে— অ্যালার্জিক ও নন অ্যালার্জিক। তাই রোগীর কোন ধরনের অ্যাজমা হয়েছে তা বোঝা খুব জরুরি।

চিকিৎসা
ঠিক কোন ধরনের ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করলে রোগীর উপকার হবে তা চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করেন। রোগীকে ব্রঙ্কোডায়ালেটর দেওয়া হয় সংকুচিত শ্বাসনালীকে খুলে দেওয়ার জন্য। কখনও কখনও রোগীকে ইনহেলারের সাহায্যে বিশেষ ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়ারও দরকার পড়তে পারে।

প্রতিরোধ
• গদিওলা বিছানা, মোটা কম্বলে হাউজডাস্ট মাইট (একধরনের ক্ষুদ্র পোকা) বংশবিস্তার করে যার স্টুল অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তাই বিছানা-বালিশ-গদি বারবার রোদে দিতে বলা হয়। রোদে এই ধরনের মাইট মারা যায়।
• বদ্ধ ঘরে থাকা চলবে না। এমন ঘরে বাস করতে হবে যেখানে হাওয়া-বাতাস বয় ও রোদ ঢোকে। ঘর প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
• হাঁপানি রোগীর বাড়িতে কার্পেট না রাখা ভালো। এছাড়া হাঁপানি রোগীকে পুরনো বই, পুরনো কাপড় ঘাঁটতে দেওয়া যাবে না।
• হাঁপানি রোগীকে পার্থেনিয়াম গাছ আছে, এমন জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ ফুলের রেণু থেকে যে সমস্ত রোগীর অ্যালার্জি আছে তাঁদের ক্ষেত্রে।
• কিছু কিছু ইনহেলার রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ করে। এই ধরনের রোগপ্রতিরোধকারী ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে রোগীকে।
• অ্যাজমার রোগীর বাড়িতে লোমশ পোষ্য না রাখাই ভালো। পোষ্য থাকলেও তাকে নিয়মিত স্নান করাতে হবে বা পরিচ্ছন রাখতে হবে।
ঝুঁকি: অ্যাজমা রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। কারণ পুরনো অ্যাজমা রোগীর হঠাৎ হার্টফেল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সিওপিডি অসুখটি কী?
পুরো কথা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। অ্যাজমার মতো সিওপিডি অসুখটিও শ্বাসনালীর প্রদাহজনিত সমস্যা।
শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে বাতাস শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসের ছোট ছোট নালী বা ব্রঙ্কিওলে প্রবেশ করে। ব্রঙ্কিওলের সঙ্গে যুক্ত থাকে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র থলি বা অ্যালভিওলাস। এই থলিগুলি থেকে রক্ত প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে। সিওপিডি থাকলে বড় ও ছোট শ্বাসনালীগুলি সংকুচিত হয় ও সরু হয়ে পড়ে। অনেক শ্লেষ্মা তৈরি হয়। ফলে রোগীর প্রচুর কফ বেরতে পারে। এই রোগে অ্যালভিওলাস-এর দেওয়ালও নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ফলে অনেকগুলি অ্যালভিওলাস ভেঙে একটি অ্যালভিওলাসে রূপান্তরিত হয়। ফলে অ্যালভিওলাস-এর কার্যকরী পৃষ্ঠতল কমে যেতে থাকে। গ্যাস স্থানান্তরে সমস্যা হয় বা বলা ভালো শরীরে অক্সিজেন প্রবেশ ও কার্বন-ডাই অক্সাইড বের হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। কিছু কিছু সিওপিডি রোগীর ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়া ও অ্যালভিওলাস-এর দেওয়াল নষ্ট হয়ে যাওয়া— দুইই দেখা যায়।

উপসর্গ
• অনেকসময় রোগীর খুকখুক করে কাশি হয়।
• কাশির সঙ্গে কফ বেরয়।
• শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় বাঁশির মতো আওয়াজ বের হতে পারে।
• হাঁটাহাঁটি করলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয় সিওপিডি রোগীর। রোগের অগ্রগতির সঙ্গে দেখা যায়, সামান্য হাঁটাহাঁটিতেই রোগীর শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ছে! মুশকিল হল, বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার তুলনায় বিশ্রামে থাকা শ্রেয় মনে করেন। ফলে অসুখ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে।

কারণ
দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণযুক্ত এলাকায় বাস করলে, সিগারেট-বিড়ি খেলে ধীরে ধীরে সিওপিডি শুরু হয়। এছাড়া অনেকদিন ধরে ঘুঁটে, কাঠ-কয়লার উনুনের ধোঁয়ার উৎসের কাছাকাছি থাকলেও সিওপিডি হতে পারে।

রোগ নির্ণয়
প্রাথমিকভাবে লাং ফাংশন টেস্ট, চেস্ট এক্স-র করলে রোগ ধরা পড়ে যায়। লাং ফাংশন টেস্ট-এর মধ্যে মূলত রয়েছে— স্পাইরোমেট্রি। এই পরীক্ষায় একটি নলে রোগীকে জোরে ফুঁ দিতে বলা হয়। এই পরীক্ষায় নির্দিষ্ট সময়ে ফুসফুস কতটা বাতাস ধারণ করতে পারছে ও কতটা বাতাস বের করতে পারছে তা বোঝা যায়। অনেকসময় রোগীর ডিফিউশন ক্যাপাসিটি (অ্যালভিওলাই থেকে রক্তবাহী জালিকায় গ্যাস স্থানান্তরের ক্ষমতা) দেখার দরকার হতে পারে। সিওিপিডি রোগে হার্টের সমস্যাও হয়। তাই রোগীর ইকোকার্ডিওগ্রাফি করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসা
চিকিৎসার মাধ্যমে রোগের অগ্রগতিকে লাগাম পরানোর চেষ্টা করা হয়। রয়েছে ব্রঙ্কোডায়ালেটর দিয়ে চিকিৎসা। নিয়মিত রোগীকে ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে। কখনও কখনও বিশেষ পরিস্থিতিতে রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়ারও দরকার পড়তে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে একটানা অনেকক্ষণ অক্সিজেনও দিতে হয়।
মনে রাখবেন, সিওপিডি রোগীর অন্যান্য জটিল ধরনের শারীরিক সমস্যাও থাকতে পারে। এই ধরনের শারীরিক সমস্যাগুলিরও চিকিৎসা করার দরকার। মোট কথা, সার্বিক সুস্থতার দিকে নজর দিলে রোগী’র সিওপিডি রোগটিও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সিওপিডি রিহ্যাবিলিটেশন
এই পদ্ধতিতে রোগীর জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন করা হয়। কিছু কিছু রেসপিরেটরি এক্সারসাইজ অভ্যেসও করতে বলা হয় রোগীকে। এছাড়া রোগীর কফ বের করিয়েও তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করা হয়। মোট কথা পুষ্টি, শরীরচর্চা, ফিজিওথেরাপি, ইনহেলার, অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়।

আশার কথা
অ্যাজমা এবং সিওপিডি-এর রোগীকে সুস্থ রাখা নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন চিকিৎসক ও গবেষকরা। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু নতুন ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে যার মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা করা যাচ্ছে আরও ভালোভাবে। আশা করা যায়, আগামীদিনে আরও উন্নতমানের ওষুধের সাহায্যে রোগীকে বেশি ভালো রাখা যাবে, এমনকী রুখেও দেওয়া যাবে রোগের অগ্রগতি!

 

সিলেট সান/এসএ

Editor Incharge: Faisal Ahmed Bablu

Office : 9-C, 8th Floor, Bluewater Shopping City, Zindabazar, Sylhet-3100

Phone: 01711487556, 01611487556

E-Mail: sylhetsuninfo@gmail.com, newssylhetsun@gmail.com

Publisher: Md. Najmul Hassan Hamid

UK office : 736-740 Romford Road Manor park London  E12 6BT

Email : uksylhetsun@gmail.com

Website : www.sylhetsun.net