রাতের আলোর উজ্জ্বলতা বিশ্লেষণ করে বন্যার ঝুঁকি পরিমাপের অভিনব এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে গত ২০ বছরে এই ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্যাটেলাইট থেকে তোলা রাতের ছবি বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন নদ-নদীর অববাহিকা এবং প্লাবন-ভূমিতে মানুষের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে।
রাত্রিকালীন এই লাইট থেকে দেশের কোথায় কোথায় মনুষ্য-বসতি গড়ে উঠেছে - সে সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গত দুই দশকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে রাতের উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
বর্তমানে এই এলাকা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করেছে। এই গবেষণার এক হিসেবে দেখা গেছে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে - যারা নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস করে। আর যারা ঘন ঘন বন্যা বা অতিবন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যার জন্য বিজ্ঞানীরা জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করলেও তারা বলছেন হাওর এলাকায় মানুষের নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। এই গবেষণায় নাসার একাধিক স্যাটেলাইট থেকে তোলা বাংলাদেশের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে দু'বার করে এসব ছবি তোলা হয়। একবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা এবং আরেকবার রাত দুটো থেকে তিনটার মধ্যে এসব ছবি ধারণ করা হয়েছে। প্রায় দুই দশক ধরে তোলা এসব ছবি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখার চেষ্টা করেছেন কোথাও কোথায় আলোর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু এই রাত্রিকালীন আলোর এই ঔজ্জ্বল্য দিয়ে কিভাবে বন্যার ঝুঁকি পরিমাপ করা হলো? এই প্রশ্নের জবাবে গবেষণা দলের প্রধান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, "রাত্রের আলো আমাদের কিছু বিশেষ ধারণা দেয়। এই আলো থেকে আমরা মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে একটা চিত্র পেতে পারি।" "কোথায় উজ্জ্বলতা বেশি, কোথায় কম, কেন বেশি, কেন কম - এসব বিশ্লেষণ করে আমরা মানুষের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ধারণা পেতে পারি।
সেটা হতে পারে বসতবাড়ি, কলকারখানা অথবা নানা ধরনের অবকাঠামো।" রাতের এই আলোর সাহায্যে বোঝা যায় কোথায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে এবং কোথায় বসতি হয়নি। এই গবেষণায় আরো যুক্ত ছিলেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. আরিফ মাসরুর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহবুব মুর্শেদ।
কী পাওয়া গেল গবেষণায় এই গবেষণায় ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা রাতের আলোর পাশাপাশি ভৌগলিক তথ্য, ভূমির ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যার বণ্টন, বিদ্যুতের সরবরাহ ইত্যাদি তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে সারা দেশে গত ২০ বছরে কী পরিমাণ প্লাবন-ভূমি মানুষের দখলে চলে গেছে।
এবং এর ফলে কোন কোন অঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দেশে বড় বড় নগর বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, যশোর, খুলনা এসব শহরে যেসব প্লাবন-ভূমি আছে সেগুলো গত ২০ বছরে মানুষের দখলে চলে যাচ্ছে।
এছাড়াও ছোট বড় যেসব নদ নদী আছে সেগুলোর অববাহিকায় অর্থাৎ দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মানুষের উপস্থিতির হার ২০০০ সালের তুলনায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেটে রাতের আলোর ঔজ্জ্বল্য বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় এবছর ভয়াবহ বন্যায় লাখ লাখ মানুষ পানি-বন্দী হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এরকম পানি তারা তাদের জীবনেও দেখেননি।
গবেষকরা বলছেন, সিলেট অঞ্চলের বর্তমান বন্যার পেছনেও বড় কারণ প্লাবন-ভূমি এবং হাওড়ের ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ। তারা বলছেন, সিলেট অঞ্চলে নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মানুষের কর্মকাণ্ড অত্যধিক বেড়ে গেছে।
তারা বলছেন, স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এই অঞ্চলে রাতের উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। "আমরা দেখেছি ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সারা দেশেই আলোর ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে। তবে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সিলেট বিভাগে।
এই ১৮ বছরে সেখানে রাতের আলোর উজ্জ্বলতা প্রায় ৬৫% বৃদ্ধি পেয়েছে - যে অঞ্চলে এখন বন্যা হচ্ছে," বলেন ড. আশরাফ দেওয়ান। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আলোর উজ্জ্বলতা থেকে সিলেটের হাওড় অঞ্চলে মানুষের হস্তক্ষেপ কতোটা বেড়েছে সেবিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
তারা বলছেন নদীর অববাহিকায়, প্লাবন-ভূমি ও হাওড় এলাকায় বসত-ভিটাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। "এর ফলে বন্যার পানি একবার জনবসতিতে ঢুকলে সেটা আর বের হতে পারছে না, আর সেকারণে বন্যা প্রলম্বিত হচ্ছে - যার ফলে মানুষের দুর্দশা এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, এর সঙ্গে যখন স্থানীয় বৃষ্টিপাত যোগ হয় তখন পরিস্থিতির আরো মারাত্মক রূপ নেয়। এবার সিলেটে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নদীর অববাহিকায় উজ্জ্বলতা রাতের আলোর ঔজ্জ্বল্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৯২% হ্রাস পেয়েছে, তৃণভূমি কমেছে ৬% এবং অনুর্বর ভূমি কমেছে ২৮%।
নদীর এই দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে নগরায়ন এবং কলকারখানার সংখ্যা। গত ২০ বছরে এই বৃদ্ধির হার ১২%।" আশরাফ দেওয়ান বলেছেন, "এই জায়গার মধ্যে মানুষের খবরদারি ও হস্তক্ষেপ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে যার ফলে মানুষের বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, নদ-নদীর আশেপাশের প্লাবন-ভূমিতে গড়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তাদের বসতি গড়ে তুলছে এবং তার ফলে বন্যার ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
Editor Incharge: Faisal Ahmed Bablu
Office : 9-C, 8th Floor, Bluewater Shopping City, Zindabazar, Sylhet-3100
Phone: 01711487556, 01611487556
E-Mail: sylhetsuninfo@gmail.com, newssylhetsun@gmail.com
Publisher: Md. Najmul Hassan Hamid
UK office : 736-740 Romford Road Manor park London E12 6BT
Email : uksylhetsun@gmail.com
Website : www.sylhetsun.net