সুনামগঞ্জে ৩০০ কোটি টাকার ধান পানিতে
স্টাফ রিপোর্টার, সুনামগঞ্জ ||
২০২২-০৫-০৯ ২২:৩৩:৫৫
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলার ৩১টি হাওরের ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ধান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। স্থানীয় কৃষক, হাওরের ফসলরক্ষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত সংগঠনসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। যা থেকে ২৮ হাজার ৮৭৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হতো। কৃষি বিভাগের এই তথ্যের সাথে একমত নন জেলার কৃষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন। তাদের মতে, কৃষি বিভাগ হাওরের ফসলের প্রকৃত চিত্র গোপন করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে লুকোচুরি করছে।
এ প্রসঙ্গে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, কৃষি বিভাগ বলছে ২০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের পরিসংখ্যানে এর চিত্র কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। ৩১টি হাওরের ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। এ নিয়ে কৃষি বিভাগ কেন লুকোচুরি খেলছে তা আমাদের মাথায় আসে না। লুকোচুরি না করে প্রকৃত তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করতে হবে।
তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন ও ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্যের জন্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা প্রয়োজন।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, আমরা হাওরের ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে একটা স্টাডি করছি। যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। তবে, এই মুহূর্তে বলতে গেলে তলিয়ে যাওয়া ফসলের পরিমাণ ১৫ হাজার হেক্টর হতে পারে। প্রতি হেক্টরে ৬ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হলে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৯০ হাজার মেট্রিক টন ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এর ক্ষতির পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। অনেকে একেবারে কাঁচা ধান কেটেছেন। যা ওজনে কম হবে। এটাও একটা ক্ষতির অন্যতম কারণ।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, মূল হাওরের ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। হাওরের উপরের অংশের প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমির ফসল এখনো কাটা বাকি রয়েছে। ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ৫ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। এতে ২৮ হাজার ৮৭৫ মেট্রিক টন ধানের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ধানের পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি টাকা।
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে প্রণোদনা দেবে কৃষি বিভাগ। এজন্যে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। আগামী কৃষি মৌসুমে প্রণোদনা দেয়া হবে।
জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় ও আসাম প্রদেশে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে মার্চের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করেই সুনামগঞ্জের সকল নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকে।
২ এপ্রিল শনিবার থেকে শুরু করে ২৬ এপ্রিল মঙ্গলবার পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে জেলার ছোট বড় ৩১টি হাওরের প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। হাওর বাঁচাও আন্দোলন সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের পর সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি হেক্টর জমিতে ৫ মেট্রিক টন বা ১২৫ মণ ধান উৎপাদন হয়।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তলিয়ে যাওয়া ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হতো ১ লাখ মেট্রিক টন বা ২৫ লাখ মণ ধান। যার বাজারমূল্য ২৫০ কোটি টাকা।
কৃষি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা এক কেদার জমিতে ১৫ মণ ধান উৎপাদনের হিসেব ধরেছে। কিন্তু জেলার অধিকাংশ হাওরে এক কেদার জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ২৭ মণও উৎপাদন হয়েছে। আবার অনেক জমিতে ১৫ মনের নিচেও উৎপাদন হয়।
কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রতি হেক্টর জমিতে ৬ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হলে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন বা ৩০ লাখ মণ ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। যার বর্তমান বাজারদাম প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ঢলের পানিতে ৩০০ কোটি টাকার ধানের পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও হাওররক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়া অবস্থার মধ্যে অনেক হাওরে ৪ আনা পাকার আগেই ধান কাটা হয়েছে।
প্রায় ১২ আনা কাঁচা ধান কেটেছেন হাজার হাজার কৃষক। কাঁচা ধান কাটার কারণে অনেকের উৎপাদনও কমে যায়। কাঁচা ধান শুকানোর পর অস্বাভাবিকভাবে ওজনও কমে যায়। তলিয়ে যাওয়া ফসলের সাথে কাঁচা ধান কাটার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এর হিসাব কিন্তু কেউই যোগ করেন না। ফলে ধান কাটলেও কৃষক ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত রয়ে যান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার নজরখালির বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। ৪ এপ্রিল ছাতক উপজেলার গোয়া-পান্ডুয়া, নাগাউন্দা, পুটিয়া ও জল্লার হাওরের ৭১ হেক্টর, একইদিন শাল্লা উপজেলায় বাঁধ উপচে বাঘার হাওরের ৪২৫ হেক্টর এবং পরদিন ৫ এপ্রিল পানি উপচে একই উপজেলার কৈয়ারবন্দ ও পুটিয়ার হাওরের ৪০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। ৫ এপ্রিল ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল উপ প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে চন্দ্র সোনার থাল হাওরের প্রায় ২ হাজার হেক্টর, একইদিন সোনামরল হাওর উপ-প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল তলিয়ে যায়।
৬ এপ্রিল পানি উপচে শাল্লা উপজেলার গোব্বরহরি হাওরের ৪০ হেক্টর, একইদিন দিরাই উপজেলার দ্বিতীয় বৃহৎ হাওর চাপতির হাওরে বৈশাখির বাঁধ ভেঙে চাপতির হাওরের প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। জেলার বড় হাওরগুলোর অন্যতম হচ্ছে চাপতির হাওর। শুধুমাত্র চাপতির হাওর তলিয়ে যাওয়ায় দিরাই উপজেলার দিরাই পৌরসভা, তাড়ল ইউনিয়ন, জগদল ইউনিয়ন ও করিমপুর ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। ওইদিন দিরাই উপজেলার টাংনির হাওরের জারালিয়া খেয়াঘাটের বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করলে হাওরের ফসল হুমকির মুখে পড়ে।
পরবর্তীতে কৃষকরা বাঁধটি মেরামত করেন। ৮ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার ফল্লিয়ারদাইড় আফার দিয়ে পানি প্রবেশ করে এরালিয়া হাওরের ১৬০০ হেক্টর এবং একইদিন মধ্যনগর উপজেলার পাওধোয়া বাঁধ ভেঙে মুক্তারখলা হাওরের ৯৬৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। ১৭ এপ্রিল গুরমার বর্ধিত অংশ উপ-প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে গুরমার হাওরের ২ হাজার হেক্টর এবং একইদিন দিরাই উপজেলার হুরামন্দিরা বাঁধ ভেঙে ১২০০ হেক্টর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার আইডরা বিল, পুরাইডরা, নউল্লা, বইশমারা, বারকুল, সিলাইন, ডাবরবিল, মরা ডাবরের ৪৮৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়।
এছাড়াও ওইদিন নদীর পানি উপচে জগন্নাথপুর উপজেলার গলাকাটা হাওর ও শেওরারবন হাওরের ৩২৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। ২০ এপ্রিল মধ্যনগরের ইন্দরপুর বাঙ্গালভিটার বাঁধ ভেঙে রাঙ্গামাটির হাওরের ১০০ হেক্টর, জগন্নাথপুর হাপাতির হাওরের ১০০ হেক্টর, জগন্নাথপুর আহমদাবাঁধ হুন্দাবিলের ৭৫ হেক্টর, ২১ এপ্রিল কোন্দানাল ব্রিজের পুটিয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৫০০ হেক্টর, ২৪ এপ্রিল শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০০০ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল জামালগঞ্জ উপজেলার আছানপুরে বাঁধ ভেঙে হালির হাওরের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
সিলেটসানডটকম - সিলেটসানডেস্ক
Editor Incharge: Faisal Ahmed Bablu
Office : 9-C, 8th Floor, Bluewater Shopping City, Zindabazar, Sylhet-3100
Phone: 01711487556, 01611487556
E-Mail: sylhetsuninfo@gmail.com, newssylhetsun@gmail.com
Publisher: Md. Najmul Hassan Hamid
UK office : 736-740 Romford Road Manor park London E12 6BT
Email : uksylhetsun@gmail.com
Website : www.sylhetsun.net