২০২০-১০-২১ ০৪:৩৮:১৫ / Print
সুচিত্রা মিত্র। একজন প্রথিতযশা ও স্বনামধন্য বাঙালি কণ্ঠশিল্পী। রবীন্দ্রসংগীতের একজন অগ্রগণ্য গায়িকা ও বিশেষজ্ঞ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭১সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত " আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" গানটি বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
১৯২৪ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতবর্ষে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা রামায়ণ-অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝা’র উত্তর পুরুষ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক। মায়ের নাম সুবর্ণলতা দেবী।
খুব অল্প বয়সে সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করেন। বাবা ছিলেন রবীন্দ্র সংগীতের বিশেষ অনুরাগী। ছেলেবেলায় তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ সাহচর্য লাভ করেছিলেন।
১৯৪১ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে বৃত্তি লাভ করেন।
১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পরিত্যাগ করে শান্তিনিকেতন চলে যান।
১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন।
১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসাবে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিযেট পাশ করেন। একই বছর রবীন্দ্র সংগীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন৷ এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকেই অর্থনীতিতে সম্মান-সহ বিএ পাস করেন।
সুচিত্রা কলেজে পড়ার সময় থেকে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে দেখা যায় গণনাট্য সংঘে, কফি হাউসে বা ধর্মতলায় বামপন্থী শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডায়, এমনকি মিছিলেও। সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গণনাট্য আন্দোলনের কর্ণধারদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্য তৈরি হয়। পরিচয়ের বৃত্তে আসেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে।
১৯৪৭ সালের ১ মে ধ্রুব মিত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৫০ সালে ২৩ জুন জন্ম হয় তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান কুণাল মিত্রের।
১৯৫৫ সালে স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় সুচিত্রা মিত্রের।
১৯৬০ সালে দিল্লী থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর জাতীয় অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। আকাশবাণীতে জওহরলাল নেহেরুকে কটাক্ষ করে বাল্মিকী প্রতিভায় গান গাওয়ার অভিযোগে তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ ছ'বছর তিনি আকাশবাণীতে গান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে জুলাই মাসে কলকাতার রাজপথে সেখানকার বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা যে মিছিল বের করে তার অগ্রভাগে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। শরণার্থীদের তহবিল সংগ্রহের জন্যও বহু অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় সঙ্গীতসহ দেশপ্রেমের গান গেয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে পথে পথে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়ে ছিলেন।
১৯৭৩ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। এখানে তার কর্মজীবন শুরু হয় প্রভাষক হিসাবে। তারপর পদোন্নতি পেযে রিডার হয়েছেন, অধ্যাপক হয়েছেন এবং "রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের" প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন৷ ২১ বছর একনাগাড়ে শিক্ষকতা করেন।
১৯৮৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী থেকে অবসর নেন। রবীন্দ্র ভারতীতে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত থাকাকালে তিনি বাংলায় এমএ পাস করেন।
১৯৮৬ সালে সংগীত নাটক অকাদেমি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এইচএমভি গোল্ডেন ডিস্ক এ্যাওয়ার্ড, বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম,পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে আলাউদ্দিন পুরস্কার লাভ করেছেন। পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার-সহ নানা সম্মান। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তাকেঁ নিযে কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে এবং নীরেন্দ্রনাথ।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেনঃ
আকাশ যখন চক্ষু বোজে
অন্ধকারের শোকে
তখন যেমন সবাই খোঁজে
সুচিত্রা মিত্রকে,
তেমন আবার কাটলে আঁধার
সুর্য্য উঠলে ফের
আমরা সবাই খোঁজ করি কার?
সুচিত্রা মিত্রের।
তাঁরই গানের জোৎস্নাজলে
ভাসাই জীবনখানি
তাইতো তাকে শিল্পী বলে
বন্ধু বলে জানি।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যার সময় সব শিল্পীদের নিয়ে কলকাতা শহরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই অর্থ বাংলাদেশে এসে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে সাহায্যে করে গেছেন।
২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরন করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।একমাত্র আমেরিকা প্রবাসী পুত্র কুণাল মিত্রকে রেখে গেছেন।
২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি সুচিত্রা মিত্রের মরদেহ নিয়ে এক বিরাট গণশোক যাত্রা বের হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, রবীন্দ্রসদন ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগীত বিদ্যালয় রবিতীর্থে গুণমুগ্ধ, অনুরাগী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অপরাহ্নে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গঙ্গায় শিল্পীর অস্থি-বিসর্জন দেন তাঁর ভাইঝি সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবদানের জন্য মরণোত্তর সুচিত্রা মিত্রকে " মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা" প্রদান করা হয়।
ভারতের প্রখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা ব্যারিষ্টার স্নেহাংশু আচার্য চৌধুরীর শ্যালিকা হলেন সুচিত্রা মিত্র।
(ভি ডি নিউটন)
লেখক: পরিচালক- জামালপুর গান্ধী আশ্রম।