মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ইংরেজী, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বাংলা ENG

নজরুলের বিদ্রোহী সাহিত্য ও জীবনকর্ম

আল-আমিন::

২০২২-০৫-২৫ ০২:৪৭:৩৫ /

'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে-মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।' '

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!'

'বল বীর- বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!'

'থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে- কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।'

'চল্ চল্ চল্। ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী-তল, অরুণ প্রাতের তরুণ-দল চলের চলের চল্ চল্ চল্ চল্।'

'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।

ওরে ও তরুণ ঈশান, বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।'

'মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল, মোরা বিধাতার মত নির্ভয় মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।'

'তোরা সব জয়ধ্বনি কর্! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্' 'আমি যুগে যুগে আসি,

আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

সাত সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,

মম ধূম-কুণ্ডুলি করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘর ঘোলাটে!

' এই সৃষ্টির স্রষ্ট্রা কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ,

প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্য সর্বাধিক পরিচিত।

তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

বাঙালি মণীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম।

তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত।

তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।

বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম।

একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সর্বদাই সোচ্চার।

তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ; ২৪ মে ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম।

কবির ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যু হলে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পরিবারের

ভরণ-পোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাযারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন।

তিনি গ্রামের মকতব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন।

শৈশবের এ শিক্ষা ও শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম অল্পবয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক জ্ঞান পবিত্র

কুরআন পাঠ, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ করেন।

তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত।

রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

কবির সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা,

 

সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।

এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদন্ডে দন্ডিত করে।

কাজী নজরুল ইসলামও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে

ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ব্যতিক্রমী এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা আগে কখনও ব্যবহৃত হয়নি।

কবিতায় তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে ধারণ করায় অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিকর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন।

কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন।

নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন এবং দূর ও অতীতের ইতিহাস, সমভাবে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব।

বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের

দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন এবং লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা গানকে উপমহাদেশের

বৃহত্তর মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি কাজী নজরুল ইসলামের মৌলিক সঙ্গীতপ্রতিভার পরিচায়ক।

নজরুলসঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের অণুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ।

বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তর করেন।

এরপর কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন।

ঐসব লোকনাট্যের দলে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা।

কাজী নজরুল ইসলাম কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশলে কবি লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন।

 

এ সময় লেটোদলের জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি চাষার সঙ,

শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ,

বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির পর কাজী নজরুল ইসলামের ছাত্রজীবনে আবার বিঘ্ন ঘটে।

মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে, পরে এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে

এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নেন।

 

চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে কবির পরিচয় হয়

 

এবং তাঁর সুবাদেই কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার

ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান

এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন।

এ স্কুলে কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৫-১৭ সালে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।

প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে কাজী নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর কাজী নজরুল ইসলামের সামরিক জীবনের পরিধি ঘটে।

এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন।

 

রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলভীর নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে

 

দেশি বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন।

 

করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবির রচনাবলির মধ্যে রয়েছে

‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'মুক্তি' এবং অন্যান্য রচনা: গল্প হেনা,

ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা আশায়, কবিতা সমাধি প্রভৃতি।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা- প্রবাসী,

 

ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন।

তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থেকেই।

 

শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর তখন সদ্যরচিত বাঁধন-হারা উপন্যাস এবং বোধন,

শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

 

বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু'দশক বাংলার দুই প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।

নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধের জন্য ওই বছরেরই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে ঐ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের দৃষ্টি পড়ে।

১৯২২ সালে কবির যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী।

বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নিবীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়;

 

কারণ এ কাব্যে নজরুলের প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, বিদ্রোহী, কামাল পাশা প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল।

 

১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলামের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ।

পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল।

 

এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় কাজী নজরুল ইসলামের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২ সালে।

একই দিনে কাজী নজরুল ইসলামকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়।

বিচারাধীন বন্দি হিসেবে ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি কাজী নজরুল ইসলাম আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে যে জবানবন্দী প্রদান করেন,

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা 'রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্য-মর্যাদা পেয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলাম যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য তাঁকে উৎসর্গ করেন।

এ ঘটনায় উল্লসিত কাজী নজরুল ইসলাম জেলখানায় বসে তাঁর অনুপম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ রচনা করেন।

 

১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলামকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯২৩ সালের ১৮ জুন বহরমপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং এক বছর তিন সপ্তাহ কারাবাসের পর ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

 

হুগলি জেলে বসে কবি রচনা করেন ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল’,

আর বহরমপুর জেলে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ এ বিখ্যাত গান দুটি।

 

কাজী নজরুল ইসলামের প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার প্রথম সংকলন দোলন চাঁপা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের অক্টোবরে।

এতে সংকলিত দীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’-তে কাজী নজরুল ইসলামের রোমান্টিক প্রেম চেতনার বহুমাত্রিক স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।

১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা সংকলন বিষের বাঁশী এবং একই মাসে ভাঙ্গার গান প্রকাশিত হয়।

দুটি গ্রন্থই ওই বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।

রাজনীতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল সাপ্তাহিক লাঙ্গল পত্রিকা প্রকাশ।

তিনি এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এর প্রথম সংখ্যাতেই কবির ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসমষ্টি মুদ্রিত হয়। লাঙ্গল ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম শ্রেণিসচেতন সাপ্তাহিক পত্রিকা।

এতে প্রকাশিত ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলে’র ম্যানিফেস্টোতে প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়।

এ সময় কাজী নজরুল ইসলাম পেশাজীবী শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের উপযোগী সাম্যবাদী ও সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন।

১৯২৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন এবং বাংলা গানে এক নতুন ধারার সংযোজন করেন।

তিনি স্বদেশী গানকে স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বহারা শ্রেণির গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন।

১৯২৫ সালে কাজী নজরুল ইসলামের প্রকাশনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: গল্প-সংকলন- রিক্তের বেদন, কবিতা ও গানের সংকলন চিত্তনামা, ছায়ানট, সাম্যবাদী ও পূবের হাওয়া।

হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের অগ্রদূত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে এই জাতীয় কবি কর্তৃক রচিত গান ও কবিতা নিয়ে চিত্তনামা গ্রন্থটি সংকলিত হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা গজল আর গানের স্রষ্টা। গণসঙ্গীত ও গজলে যৌবনের দুটি বিশেষ দিক সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যাই ছিল মুখ্য।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম গজল আঙ্গিক সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বৈচিত্র্য আনয়ন করেন।

তাঁর অধিকাংশ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগভিত্তিক।

আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলো উর্দু গজলের মতো তালযুক্ত ও তালছাড়া গীত।

কাজী নজরুল ইসলামের বাংলা গজল গানের জনপ্রিয়তা সমকালীন বাংলা গানের ইতিহাসে ছিল তুলনাহীন।

১৯২৬-২৭ সালে কৃষ্ণনগর জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম উভয় ধারায় বহুসংখ্যক গান রচনা করেন।

ওই সময়ে তিনি নিজের গানের স্বরলিপি প্রকাশ করতে থাকেন। এসব গান থেকে স্পষ্ট হয় যে, কাজী নজরুল ইসলাম

সৃজনশীল মৌলিক সঙ্গীত প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ ঘটে ১৯২৬-২৭ সালে কৃষ্ণনগরে।

অথচ কাজী নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগর জীবন ছিল অভাব-অনটন, রোগ-শোক ও দুঃখ-দারিদ্র্যক্লিষ্ট।

১৯৩০ সালে মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী নাটক কারাগারে কাজী নজরুল ইসলামের আটটি গান ছিল,

নাটকটি একটানা ১৮ রজনী মঞ্চস্থ হওয়ার পর সরকার নিষিদ্ধ করে। ১৯২৮-২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামের প্রকাশিত কবিতা ও গানের সংকলনের মধ্যে ছিল:

সিন্ধু-হিন্দোল, সঞ্চিতা, বুলবুল, জিঞ্জীর ও চক্রবাক। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কবির রাজনৈতিক উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা, গানের সংকলন নজরুল-গীতিকা,

নাটিকা ঝিলিমিলি এবং কবিতা ও গানের সংকলন প্রলয়-শিখা ও চন্দ্রবিন্দু। শেষোক্ত গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত এবং প্রলয়-শিখার জন্য কবির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত আদালতের রায়ে কাজী নজরুল ইসলামের ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হয় তখন।

পরে কাজী নজরুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে আপিল ও জামিন লাভ করেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস কুহেলিকা,

গল্প-সংকলন শিউলিমালা, গানের স্বরলিপি নজরুল-স্বরলিপি এবং গীতিনাট্য আলেয়া।

কবির এ নাটকটি কলকাতার নাট্যনিকেতনে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এতে গানের সংখ্যা ছিল ২৮টি।

ওই বছর কাজী নজরুল ইসলাম আরও যেসব নাটকের জন্য গান রচনা ও সুর করেন সেসবের মধ্যে ছিল যতীন্দ্রমোহন সিংহের ধ্রুবতারা

উপন্যাসের নাট্যরূপের চারটি গান মন্মথ রায়ের সাবিত্রী নাটকের ১৩টি গান ১৯৩২ সালে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত মন্মথ রায়ের

মহুয়া নাটকের গানগুলোর রচয়িতাও ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের। ১৯৩৩ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তিনটি মূল্যবান অনুবাদ-কর্ম সমাপ্ত করেন:

রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এবং কাব্য আমপারা। রেকর্ড, বেতার ও মঞ্চের পর

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩৪ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি প্রথমে যে ছায়াছবির জন্য কাজ করেন সেটি ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাহিনী ভক্ত ধ্রুব।

এ ছায়াছবির পরিচালনা, সঙ্গীত রচনা, সুর সংযোজনা ও পরিচালনা করেন কবি নিজেই। ছবির আঠারোটি গানের মধ্যে সতেরোটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন কজী নজরুল ইসলাম।

এ ছাড়া তিনি আর যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সেগুলো হলো: পাতালপুরী গ্রহের ফের, োলগোরা, নন্দিনী এবং অভিনয় নয়। বিভিন্ন ছায়াছবিতে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ব্যবহূত নজরুলসঙ্গীতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।

চলচ্চিত্রের মতো মঞ্চনাটকের সঙ্গেও কাজী নজরুল ইসলাম ত্রিশের দশকে সম্পৃক্ত ছিলেন।

১৯২৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে নিজের রচিত দুটি নাটক আলেয়া ও মধুমালাসহ প্রায় ২০টি মঞ্চ নাটকের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম যুক্ত ছিলেন

এবং সেসবে প্রায় ১৮২টি নজরুলসঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এরূপ কয়েকটি নাটক হলো: রক্তকমল, মহুয়া, জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী, আলেয়া, সর্বহারা, সতী, সিরাজদ্দৌলা, দেবীদুর্গা, মধুমালা,

অন্নপূর্ণা, নন্দিনী, হরপার্বতী, অর্জুনবিজয়, ব্ল্যাক আউট ইত্যাদি।

১৯৩৪ সালে কবির প্রকাশনার সবই ছিল সঙ্গীত-বিষয়ক, গীতি-শতদল ও গানের মালা গীতিসংকলন

এবং সুরলিপি ও স্বরলিপি সংগ্রহ। ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা

বেতারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে অনেক মূল্যবান সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচারিত হয়।

অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হারামণি, মেল-মিলন ও নবরাগমালিকা।

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাংলা ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত কাজী নজরুল ইসলাম

তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করেন রবিহারা এবং ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে শোকসঙ্গীত।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই কবি নিজেও অসুস্থ এবং ক্রমশ নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে যান।

দেশে ও বিদেশে কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়, কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যায় নি।

১৯৪২ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবির এ অসহনীয় নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত হয়।

ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে।

২৯ আগস্ট ১৯৭৬ বাংলা ১২ ভাদ্র ঢাকায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। [তথ্য সংগ্রহকৃত ] লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

এ জাতীয় আরো খবর

 আজ মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আজ মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

 বর্ণমালার মিছিলের মধ্য দিয়ে সিলেটে ভাষার মাস বরণ

বর্ণমালার মিছিলের মধ্য দিয়ে সিলেটে ভাষার মাস বরণ

শুভ বড়দিন আজ

শুভ বড়দিন আজ

স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণতা প্রাপ্তির ঐতিহাসিক দিন আজ

স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণতা প্রাপ্তির ঐতিহাসিক দিন আজ

 আজ ১৫ ডিসেম্বর ‘সিলেট মুক্ত দিবস’

আজ ১৫ ডিসেম্বর ‘সিলেট মুক্ত দিবস’

শেখ রাসেল: জানার আছে অনেক কিছু

শেখ রাসেল: জানার আছে অনেক কিছু